স্টাফ রিপোর্টার ॥ হবিগঞ্জ শহরে তরুণ লীগ নেতা চাঞ্চল্যকর সৈয়দ রুহুল ইসলাম পাভেল হত্যা মামলায় ২ জনের ফাঁসি ও ২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক দিলীপ কুমার দেবনাথ এ রায় প্রদান করেন। রায়ে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় সাংবাদিকসহ ৩ জনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। আদালত ৫২ জন স্বাক্ষীর মধ্যে ৩৬ জনের স্বাক্ষ্য গ্রহণ করেন।
ফাঁসির আদেশ হওয়া আসামিরা হচ্ছে-হবিগঞ্জ সদরের তেঘরিয়া গ্রামের ফরিদ মিয়ার ছেলে পাভেল আহমদ (২৭) ও নারায়নপুরের আবদুল খালেকের ছেলে আবদুর রউফ (৩৪)। যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশপ্রাপ্তরা হলেন-হবিগঞ্জ শহরের মুসলিম কোয়ার্টারের মৃত সৈয়দ আবদুল মতিনের ছেলে সৈয়দ গোলাম জিলানী (৩৯) ও মাছুলিয়া এলাকার মৃত রইছ উদ্দিনের ছেলে শাহীন মিয়া (২৪)। এ দুইজনকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের পাশাপাশি প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরো এক বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
খালাসপ্রাপ্তরা হলেন-হবিগঞ্জ সদরের বড় বহুলা গ্রামের এমাদুল হক সোহেল (২৯), অনন্তপুরের আবদুল কাদির (২৫) ও চুনারুঘাটের আহমদাবাদ ইউনিয়নের বনগাঁও গ্রামের মানিক মিয়ার ছেলে আবদুর রাজ্জাক রাজু (২৬)। রাজু ঘটনার পর থেকেই পলাতক ছিল। নিহত সৈয়দ রুহুল ইসলাম পাভেল হবিগঞ্জ সদর উপজেলার দিঘলবাগ গ্রামের মৃত সৈয়দ আলতাব মিয়ার পুত্র। তারা হবিগঞ্জ শহরের ইনাতাবাদ এলাকায় বসবাস করতেন।
২০১০ সালের ২২ নভেম্বর বিকেলে ব্যবসায়ী সৈয়দ রুহুল ইসলাম পাভেলকে তার ইনাতাবাদের বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায় তার বন্ধু পাভেল আহমদসহ কয়েকজন। রাত ১০টায় বাসায় না ফেরায় তার স্ত্রী নাজরাতুন নাঈম মৌসুমী ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। এসময় তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পাভেলকে সম্ভাব্য সব স্থানে খোজাখুজি করেও তার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। রাত পৌণে ১১ টায় পাভেলের মোবাইল থেকে তার স্ত্রীর মোবাইলে একটি ম্যাসেজ পাঠানো হয়। পাভেলের স্ত্রীর মোবাইলটি বন্ধ থাকায় পরদিন ২৩ নভেম্বর বিকেলে মোবাইলটি অন করলে ওই ম্যাসেজটি তার মোবাইলে ইন করে। ম্যাসেজে লেখা ছিল “রাগ করোনা, মাকে বলিও আমি রাতে বাসায় ফিরবনা, আমি আমার বসের সাথে আছি”।
২৪ নভেম্বর ভোর রাত প্রায় সাড়ে ৪টার দিকে তার স্ত্রীর মোবাইল থেকে পুনরায় রিং দেয়া হয় পাভেলের নাম্বারে। এ সময় অজ্ঞাত ব্যক্তি মোবাইল রিসিভ করে পাভেলের বন্ধু পরিচয় দিয়ে সে ঘুমিয়ে আছে বলেই ফোন বন্ধ করে দেয়। ২৫ নভেম্বর বেলা আড়াইটার দিকে হবিগঞ্জ শহরের পুরাতন হাসপাতাল সড়ক এলাকায় ডাঃ তপন কুমার দাশ গুপ্তের বাসার সীমানা দেয়াল এবং তৎকালীন দৈনিক লোকালয় বার্তা পত্রিকা অফিস ও রাজফ্যাশন ভবনের মাঝখানের সরুস্থানে বস্তাবন্দি অবস্থায় পাভেলের লাশ পাওয়া যায়। লাশের দু’হাত স্কচটেপ ও দড়ি দিয়ে বাধা এবং মুখমন্ডল স্কচটেপ দিয়ে মুড়ানো ছিল। ওই দিন সন্ধ্যায় পুলিশ সুপার ও ম্যাজিস্ট্রেট এর উপস্থিতিতে পাবেল আহমদের মালিকানাধিন রাজ ফ্যাশনের সাটারের তালা ভেঙ্গে ভেতরে তল্লাশি চালানো হয়। তল্লাশিকালে স্কচটেপের বান্ডিল, একটি কেচিসহ বিভিন্ন আলামত জব্দ করা হয়। পরে রাজ ফ্যাশনটি সীলগালা করা হয়।
ওই দিনই নিহত পাভেলের ব্যবসায়ীক সহযোগি গোলাম জিলানীসহ ৫জনকে সন্দেহজনকভাবে পুলিশ আটক করে। ২৭ নভেম্বর সৈয়দ পভেলের স্ত্রী নাজরাতুন নাঈম মৌসুমী বাদী হয়ে হবিগঞ্জ সদর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় হবিগঞ্জ সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) জীবন কৃষ্ণ দে কে। জীবন কৃষ্ণ দে হত্যাকারীদের খোজে বের করতে মাঠে নামেন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জীবন কৃষ্ণ দে ২৮ নভেম্বর হত্যাকান্ডের প্রধান আসামী পাভেল আহমেদ ও শাহীনকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটনের খুলশি থানার লালখান বাজার থেকে গ্রেফতার করেন। ওই দিন রাত ৮টার দিকে আব্দুর রউফ ওরফে রউফ মোল্লাকে শহরের টাউন হল রোড এলাকার মোবারক হোটেলের কাছ থেকে র্যাব তাকে আটক করে। আটককৃত রউফ মোল্লা, পাবেল, জিলানী, শাহীনসহ অন্যান্যদের রিমন্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। লোকালয় বার্তার পিয়ন জাহেদুল ঘটনার ব্যাপারে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করে।
এদিকে র্যাবের হাতে আটক আব্দুর রউফ ওরফে রউফ মোল্লা হত্যাকান্ড সম্পর্কে স্বীকারোক্তি দেয়। স্বীকারোক্তি রউফ মোল্লা জানায়, সৈয়দ পাভেলকে জিম্মি করে টাকা আদায় করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু ঘটনাচক্রে তাকে হত্যা করা হয়। ২৯ নভেম্বর হবিগঞ্জ সার্কিট হাউজে র্যাব-৯ এর শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের তৎকালীন কোম্পানী কমান্ডার কাওসার মাহমুদ প্রেস বিফ্রিং এ রউফ মোল্লার দেয়া জবানবন্দীটি সাংবাদিকদের পড়ে শুনান। রউফ মোল্লা স্বীকারোক্তিতে জানায়, রাজ ফ্যাশনের মালিক পাভেল আহমদ, আব্দুর রউফ মোল্লাসহ কয়েকজন মিলে পাভেলকে জিম্মি করে তার মা’র কাছ থেকে ২০লাখ টাকা আদায় করার পরিকল্পনা করে। ২০ লাখ টাকা আদায় করতে পারলে রউফ মোল্লাকে ৩ লাখ এবং ১০ লাখ টাকা আদায় করতে পারলে ১লাখ টাকা দেয়ার মৌখিক চুক্তি হয়। তাদের পরিকল্পনানুযায়ী গত ২৩ নভেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে পাভেলকে ব্যবসায়ীক কারণের কথা বলে শহরের পুরাতন হাসপাতাল সড়কস্থ রাজ ফ্যাশনে ডেকে আনা হয়। রাজ ফ্যাশনে আনার পর তাকে একটি ফরম পূরণ করতে দেয়া হয়। ফরম পূরণ করা অবস্থায় পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজ ফ্যাশনের মালিক পাভেল আহমদ তাকে ঝাপটে ধরে নিচে ফেলে দেয়। মাটিতে পড়ার সাথে সাথে একজন স্কচ টেপ দিয়ে তার নাক মুখ পেচাতে থাকে। এ সময় পাভেল শ্বাস প্রশ্বাস নিতে না পারায় গড় গড় শব্দ হয়। এ অবস্থায় একজন মাথায় এবং একজন পা চেপে ধরে। রউফ মোল্লা ৭ থেকে ৮ মিনিট পাভেলকে নাকে চেপে ধরে রেখে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। এ সময় লাশ সরানো ব্যবস্থা করা আছে বলে সবাইকে জানায় পাভেল আহমেদ। এ ঘটনা প্রকাশ না করার জন্য পাভেল আহমেদ অন্য সবাইকে শাসায়। কেউ প্রকাশ করলে তাকে ইনজেকশন দিয়ে পাগল করে দেয়া বলে সে সবাইকে জানিয়ে দেয়। সৈয়দ রুহুল ইসলাম পাভেল মারা যাবার পর তার শরীরে প্যাচানো স্কচটেপ কেটে জ্যাকেটের পকেট থেকে টাকা ও মানিব্যাগ নেয়া হয়। রউফ মোল্লা আরো জানায়, হত্যাকান্ডের পর তাকে (রউফ মোল্লাকে) নগদ ৫০ টাকা, তার মোবাইলে ২০ টাকার ফ্লেক্সি ও একটি সেভেনআপের বোতল হাতে দিয়ে বিদায় করে দেয়া হয়। পরদিন ২৪ নভেম্বর রাতে পাভেল মোটর সাইকেল নিয়ে রউফ মোল্লাকে আনতে যায়। এ সময় রউফ মোল্লা তার শ্বশুর বাড়িতে ছিল। তাকে শ্বশুর বাড়ি থেকে এনে ভোর ৪টার দিকে রাজ ফ্যাশনের নিচে রাস্তায় পাহারা দিতে বলে। তাকে দেখলে কেউ সন্দেহ করবেনা এ জন্যই রউফ মোল্লাকে পাহারায় দেয়া হয়। এ সময় উপর থেকে লাশ মাইক্রোযোগে সরানোর পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু পুলিশ টহল এবং লোকজনের যাতায়াতের কারণে লাশ সরানো সম্ভব হচ্ছিল না। পরে রউফ মোল্লাকে নিয়ে ঘাতক পাভেল আহমেদ নিহত সৈয়দ পাভেলের বাসায় যায় এবং তারা খোজাখুজি করছে বলে নিহত পাভেলের মা ও স্ত্রীকে শান্তনা দেয়। পরে রউফ মোল্লাকে স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে এবং অপরিচিত কোন মোবাইল না ধরার পরামর্শ দিয়ে বাড়ি যেতে বলে পাভেল আহমেদ। ২৪ নভেম্বর বিকেলে হত্যাকারীরা পাভেলের লাশ সরানোর পরিকল্পনা করে। কিন্তু সময় লাশ থেকে গন্ধ বের হওয়ায় ২৫ নভেম্বর ভোর রাত ৪টার দিকে লাশ বস্তাবন্দি করে ওই স্থানে ফেলে দেয়া হয়। এ সময় রউফ মোল্লা রাস্তায় পাহারা দিচ্ছিল। পরে পাভেল ১০ টাকা দিয়ে রউফ মোল্লাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। পাভেল মোবাইলে রউফ মোল্লাকে লাশ পাবার খবর দিয়ে তাকে স্বাভাবিক চলাচলের পরামর্শ দেয়। পাভেল হবিগঞ্জের বাইরে চলে যাবে বলেও রউফ মোল্লাকে জানায়। সে অনুযায়ী ২৬ নভেম্বর রউফ মোল্লা পাভেলের জানাযায় অংশ যোগদান করে। পরদিন ২৭ নভেম্বর বিকেলে পাভেলের শোক সভায় রউফ মোল্লা অতিথি হিসেবে অংশ নেয়।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর থানার ওসি (তদন্ত) জীবন কৃষ্ণ দে দীর্ঘ তদন্তে হত্যাকান্ডের মুটিভ উদ্ধার করতে সক্ষম হন। তদন্ত যখন শেষ পর্যায়ে তখন জীবন কৃষ্ণ দে কে ২০১১ সনের ৩ মার্চ ডিবিতে বদলী করা হয়। মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় সদর থানার তৎকালীন ওসি শেখ কবিরুল ইসলামকে। কবিরুল ইসলাম দায়িত্ব পাবার ১১ দিন পর ২০১১ সালের ১৪ মার্চ ৭ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট দাখিল করেন।